উঠোনের আমগাছটা ত্রিশ বছরের মতো হবে। বয়স শুনতে যতটা, ফলন তার চেয়ে ঢের বেশি।
গাছটা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে যেন পরিবারেরই একজন সদস্য। দাদু প্রায়ই গাছটার দিকে তাকিয়ে বলেন,
— এই গাছটা আমি ছোটবেলায় মাটিতে পুঁতেছিলাম। এখনকার ছেলেপেলেদের সেই ধৈর্য নাই।
দাদুর কথায় উঠোনে হাসির রোল পড়ে যায়। মা হাঁড়িতে পানি ঢালতে ঢালতে মুচকি হাসেন। আর কোণের দিকের ছোট্ট ছেলেটা মাটিতে কাঠি দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে—তার কাছে দাদুর এসব কথা মানেই বকবকানি।
সন্ধ্যার দিকে ঝড় উঠল। হঠাৎ বজ্রপাত, বৃষ্টি নেমে এল মুষলধারে। হাওয়ায় দুলতে দুলতে আমগাছটা যেন কেঁপে উঠল।
ছেলেমেয়েরা ঝুড়ি হাতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল।
— দৌড়, বড় বড় আম পড়তেছে!
— সাবধানে, মাথায় পড়লে শেষ!
একটার পর একটা আম পড়ে মাটিতে ছড়িয়ে গেল। হাসি-চিৎকারে উঠোন ভরে উঠল। তবু একটা আম—ডালে ঝুলে—পড়বে পড়বে করে থেমে থাকল। যেন গাছের একগুঁয়ে জেদ।
পরদিন সকাল। রোদ উঠেছে উজ্জ্বল। উঠোন ভরে আছে শুকানো আমে। রান্নাঘরে মা আচার বানাচ্ছেন।
ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছে, তবু মায়ের মুখে তৃপ্তি।
বাচ্চারা স্কুলের পোশাকে বই হাতে বের হলো।
— দুপুরের আগেই সব শেষ হয়ে যাবে, মা বললেন।
— আমার ভাগে বেশি দিও, ছেলে তৎক্ষণাৎ জবাব দিল।
দাদু মৃদু হেসে বললেন,
— গাছ বড় হয় ফলে, মানুষ বড় হয় গল্পে।
ক’দিন পর আবার গাছে উঠল গ্রাম্য কিশোরেরা। ঝুড়ি ভর্তি আম নামছে।
— সাবধানে নামিস, কৃষক চিৎকার করল, এই টাকায় মাইয়ার বিয়া দিব।
এক কিশোর ঝুড়ি কাঁধে তুলে হেসে বলল,
— আমগো সাথে আমাকেও পাঠাইলে কেমন হয়?
সবাই হেসে উঠল।
সময় কেটে যায়। সন্ধ্যা নামে অন্য এক ঘরে, দূর দেশে। এক পরিবার টেবিলে বসে আছে। টেলিভিশন বন্ধ, আলো-আঁধারি ঘর। টেবিলের মাঝখানে রাখা আছে রাজশাহীর আমের বাক্স। বাক্সটা খোলা, ভিতরে সোনালি ফল।
— এই ফলের জন্য আমাদের বাড়ি একসময় কত কষ্ট করত, বাবা মৃদু স্বরে বললেন।
দাদু ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন,
— আম কাটতে নাই, আগে বসে গল্প করি।
ঘর নিস্তব্ধ। কারও মুখে হাসি, কারও চোখে অদৃশ্য জল। টেবিলের মাঝখানে সেই আম ঝলমল করছে আলোয়। ছুরি পাশে রাখা, কিন্তু কেউ তোলে না।
ঘর নীরব। গ্রীষ্ম যেন থেমে গেছে, অনন্ত হয়ে।